-->

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের স্বরূপ সন্ধানে ‘মুকুলের গন্ধ’ || অনিল ঘড়াইয়ের মুকুলের গন্ধ

 

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের স্বরূপ সন্ধানে ‘মুকুলের গন্ধ’ || অনিল ঘড়াইয়ের মুকুলের গন্ধ

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের স্বরূপ সন্ধানে ‘মুকুলের গন্ধ’

সাম্প্রতিক বাংলা দলিত সাহিত্যের ধারায় প্রখর বাস্তববাদী লেখক অনিল ঘড়াইয়ের জন্ম ১লা নভেম্বর ১৯৫৭ সালে পূর্বমেদিনীপুর জেলার এগরা থানার অন্তর্গত রুক্মিণীপুর গ্রামে। পিতা-অভিমন্যু ঘড়াই ও মাতা – তিলোত্তমা ঘড়াই। রেলওয়ের চাকুরীর সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিহারের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জনপদ এলাকায়। কিশোর জীবনের অনেকটা সময় তাঁর কেটেছে নদীয়ার ভৌগোলিক পরিবেশে। ১৯৯১ সালে ‘সোপান সাহিত্য’ পুরস্কার প্রাপ্ত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নুনবাড়ি’। এরপর একে একে লেখেন ‘বনবাসী’ (১৯৯০), ‘মুকুলের গন্ধ’ (১৯৯৩), ‘বোবাযুদ্ধ’ (১৯৯৩), ‘তরঙ্গলতা’ (১৯৯৩), ‘কাননে কুসুমকলি’ (১৯৯৩), ‘বক্ররেখা’ (১৯৯৪), ‘প্লাবন’ (১৯৯৪), ‘ধর্মেরকল’ (১৯৯৫), ‘মেঘজীবনের তৃষ্ণা’ (১৯৯৬), ‘কালের পুতুল’ (১৯৯৬), ‘দৌড়বোগাড়ার উপাখ্যান’ (১৯৯৭), ‘খেলাঘর’ (১৯৯৮), ‘জন্মদাগ’ (১৯৯৯), ‘বিপরীত যুদ্ধের মহড়া’ (২০০১), ‘পাতাওড়ার দিন’ (২০০২), ‘সামনে সাগর’ (২০০৩) সহ ‘অনন্ত দ্রাঘিমা’ (২০০৯) মতো বিখ্যাত সব উপন্যাস। যেসকল উপন্যাসের পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে অন্ত্যজের শ্বাস-প্রশ্বাস। অসংখ্য অন্ত্যজ চরিত্রের স্রষ্টা অনিল ঘড়াইয়ের মৃত্যু বিগত ইং ২৩/১১/২০১৪ সালের শনি ও রবির সন্ধিক্ষণে রাত ১২টা ৫ মিনিটে কলকাতার মেডিকা নার্সিং হোমে। মাত্র ৫৭ বছর বয়সেই তাঁর লেখক জীবনের অবসান ঘটলেও জীবদ্দশাতেই তিনি লাভ করেছেন ‘সংস্কৃতি পুরস্কার [নিউ দিল্লী] (১৯৯১) সহ ‘মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার’ (১৯৯৬) ‘আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭) এমনকি, ‘তারাশঙ্কর পুরস্কার’ (২০০১), ‘ভারত এক্সেলেন্সি অ্যাওয়ার্ড অ্যান্ড গোল্ড মেডেল’ ‘নিউ দিল্লী (২০০২) সহ ‘ঋষিবঙ্কিম সম্মান’ (২০০৩) তাঁর ঐ ‘অনন্ত দ্রাঘিমা’ জন্য। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত এই লেখকের আলোচ্য ‘মুকুলের গন্ধ’ উপন্যাসটিতেও সেই অন্ত্যজের শ্বাস-প্রশ্বাস ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি এই উপন্যাসটির প্রথম নাম রেখে ছিলেন ‘বরাহ পুরাণ’। প্রকাশকালে এর নাম পরিবর্তন করে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দ্বারা মূলকাহিনীর সংযোজন বিয়োজন করে নাম রাখেন ‘মুকুলের গন্ধ’।

          উপন্যাসের শুরুতেই লেখক জগেন জমাদারের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফোটাতে গিয়ে খিচড়া শুয়োরের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের অনুষঙ্গে এনে দাঁড় করিয়েছেন। কারণ, খিচড়ে শুয়োর যেমন খোয়াড়ের আর পাঁচটা শুয়োরকে শান্তিতে থাকতে দেয়না, তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ করে তোলে, তেমনি জগেন জমাদার ও স্ত্রী আন্নাকালীর প্রতি অহরহ খিঁচিয়ে ওঠে। নিদারুণ অভাব-দারিদ্র আর আর্থিক সংকটে জর্জরিত জাগেনের মনটাও ঐ খিচড়া শুয়োরের মত। খিচড়া শুয়োরের স্বভাব যেমনটা ঠিক–

সে আরো সাতটা শুয়োরকে বাঁচতে দেয় না, আর বাঁচতে দিলেও দগ্ধে-দগ্ধে বেঁচে থাকতে-শেখায়।

শুকর পালনের পেশায় নিযুক্ত ঐ জগেন জমাদারদের নিত্য যাপন ক্রিয়ার নিখুঁত চালচিত্র সম্পর্কে লেখকের বাস্তবঘন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাই ঐ জীবনের নর-নারীদের আঁতের কথা টেনে বের করতে সাহায্য করেছে। অভাবের চাপের কাছে শিরদাঁড়া নুইয়ে পড়া মানুষ আপন মনুষ্যত্বটুকু ও কখনো কখনো খুইয়ে ফেলে পশুত্বে পৌঁছে যায়। স্বয়ং লেখকের তাই বক্তব্য –

মানুষ যখন পশু হয়ে যায় তখন সে মনুষ্যত্বের শেষ চিহ্ন টুকু মুছে ফেলতে পিছপা হয় না।

উপন্যাসে তারই ফলশ্রুতি হিসাবে লক্ষ্য করা যায় – জগেন বেহেড মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে স্ত্রী আন্নাকালী ঝাঁঝিয়ে ওঠে। সেই কলহ থেকে তারা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভুলে পরস্পরে হাতাহাতি পর্যন্ত শুরু করে দেয়। জগেন, স্ত্রী আন্নাকালীর চুলের মুটি শক্ত করে চেপে ধরে। তারপর বার কয়েক সেই চুলের মুটি সমেত শানের উপর ওঠায়-নামায়। আর আন্নাকালী তীব্র যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে। সে নিরুপায় হয়ে ঐ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে অত্যাচারী স্বামী জগেনের লোমশ জাং-এ গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে হাঁ করা দু’পাটিতে কামড়ে ধরে। তীব্র যন্ত্রণায় খিচড়ে শুয়োরের মতো জগেন কুঁকিয়ে ওঠে, ছেড়ে দেয় আন্নাকালীকে! দংশন ক্ষত নিয়ে জগেন সরে গেলেও; আন্নাকালী ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর করুণ অবস্থার দিকে। সে যে বাধ্য হয়েই এমন কাজ করেছে, তা পরবর্তী ঘটনায় বোঝা যায়। আন্নাকালী এমনটা চায়নিকিন্তু পরিস্থিতি ক্রমে এমন জঘন্য ঘটনা সে ঘটিয়ে ফেলেছে। এর জন্যে সে অনুতপ্তও। ভীষণ ভাবে অনুশোচনায় ডুকরে ওঠে। ঔপন্যাসিক তাঁর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি দিয়ে এই আন্নাকালী চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন –

সেই আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে অনুশোচনায় পুড়ছিল রুগ্নমন আর অশ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। এক সময় আচল কামড়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে, কাতর হয়ে বলল, যারে অর্জুন, তোর বাপরে দা পুড়িয়ে ছ্যাকা দে। বাসি মুখে কামড়ে দিয়েচি তাকে। ছ্যাতা পড়া দাঁতগুলো আমার যে বিষে বোঝাই।

আসলে, নিম্নবৃত্তিয় সমাজের নারীরা চিরকাল স্বামী-সন্তানকে ঘিরে সুখে কালাতিপাত করতে চায়। বাইরে যতই স্বামীর ওপর উষ্মা প্রকাশ করুক না কেন; মনে মনে তারা সেই পতিদেবতাটির মঙ্গল প্রার্থনা করে। স্বামী-সন্তানের জন্যেই দেবতার মন্দিরে হত্যা দেয়। অনাহারে দিন কাটায়। নিজে না খেয়ে স্বামী-সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয়। আন্নাকালী তার ব্যতিক্রম নয়। তাই উপন্যাসের চতুর্থ অধ্যায়ে গিয়ে দেখা যায় মদ্যাসক্ত জগেন অনেক রাতে ও বাড়ী না ফিরতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে আন্নাকালী ছেলে অর্জুনকে শুধায় –

যা না-রে বাপ, দেখ গে কোথায় তোর মাতাল বাপটা পড়ে আছে। তারে ধরে না আনলে ঘরে ফেরার তার যে সামর্থ্য নেই।

একটা বেহেড মাতাল, খিচড়া শুয়োর স্বভাবী বাপের জন্য মায়ের এমন উদ্বেগ আর চিন্তায় অধৈর্য হয়ে ওঠা দেখে, পুত্র অর্জুনও খানিক বিরক্ত বোধ করে বৈকি! কারণ, বাপ-মায়ের এমন অহরহ ঝগড়া-ঝাটির দৃশ্য দেখতে দেখতে সে অতিষ্ঠ; তিতিবিরক্তও। তাই, এমন বাপের জন্য মায়ের অধৈর্য হয়ে ওঠায়-অর্জুন ভাবে, -

দুটো ভাত দেয় বলে যে মানুষ দু’বেলায় চুল ছিঁড়ে হাতে দেয়, মারধোর করে, গালমন্দে বান ভাসায় তার জন্য এত টান, এত দরদ আদৌ পছন্দ হয়নি অর্জুনের!

এভাবে, ঔপন্যাসিক কিশোর অর্জুনের মনে আলো ফেলে তার মনোবিকলনের দিকটিও ফুটিয়ে তুলেছেন। অর্জুনের তিতিবিরক্ত মুখ দেখে, মা আন্নাকালীও পুত্রের মধ্যে স্বামী জগেনের স্বাভাব-বৈশিষ্ট্য খুঁজে ফেরার চেষ্টা করে। সেই শঙ্কায় আন্নাকালী ক্ষোভের সঙ্গে বলে: 

ছেলেটার জেদ ও তার বাপের মতন।

          এমন একজন মাতাল স্বভাবী জগেন চরিত্রের আঁতের কথায়ও কথাশিল্পী এই চরিত্রের ভেতর আলো ফেলে, তার মনোবিকলনের সন্ধান দিয়েছেন। আসলে, জগেনের মন পরনারীতে আসক্ত। বিধবা নারী যশোদাকে পাওয়ার কামনায় সে তীব্র আসক্ত হয়ে ওঠে। সেই বাসনার মোহে সে তার মনের কথাকে সহজ-অকপটে প্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। সংসারের অসীম দারিদ্র্যের লড়াই করতে করতে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া আন্নাকালীকে সে নির্দ্বিধায় খোঁচা দিয়ে বলতে পেরেছে –

তোকে সোহাগ করে জাপড়ে ধরলে বুকে আমার ব্যথা লাগে, শুলোয়। সেই বেদনা সারতে সারতে আর একটা বেদনা এসে জড়ো হয়। না হলে, শুধু মুধু কি আমি মদ খাই, আমার অনেক জ্বালা।

এভাবে, অকপটে নিজের মনের খবর বুঝিয়ে দেয় স্ত্রী আন্নাকালীকে। শুধু এই নয়, এমন কথায় কোন্‌ নারী ধৈর্য ধরে রাখতে পারে? তাই, রাগে-দুঃখে, অপমানে আন্নাকালী ফুঁপিয়ে ওঠে। জগেনও এভাবে শুধু কথার খোঁচায় নয়; অহরহ ঐ খিচড়া শুয়োরের মতো খিঁচিয়ে ওঠে। হাত তুলে আন্নাকালীর প্রতি চড়াও হয়। বিধবা যশোদাকে পাওয়ার কামনায় জগেন ক্রমে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তার এই আচরণে সে একেবারে অন্ধও নয়। তার মনে যে কামনা-বাসনায় না পাওয়ার দুঃখটা জমে আছে, তা স্ত্রী আন্নাকালীর কাছে সে অকপটে স্বীকারও করে নেয় –

যখন তখন আমি তোর গায়ে হাত তুলি, মারধোর করি। এর জন্য আমার সেই ক্ষয়াটে ভুখা মনটা দায়ী। আমার নজর অন্য দিকে ঢলেছে, তোর ঐ চিমড়ে শরীলে আমি আর সুখ পাইনে, হাঁপিয়ে উঠি। তুই আমারে বাঁচা, তুই না বাঁচালে যশোদাকে আমি পাবো না।

আসলে, এভাবে ঔপন্যাসিক অনিল ঘড়াই এই জগেন জমাদার চরিত্রের ভেতর আলো ফেলে তার তলদেশ থেকে রহস্য উদ্ঘাটিত করে পিয়াজের খোসার ন্যায় এক একটি পাট খুলে খুলে দেখিয়েছেন। আর এই কারণেই বোধহয় ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও মন্তব্য করে বলেছিলেন –

বাহিরের ঐ মন্থনের ফলে যে বিপুল ফেনারাশি উৎপন্ন হয় তাহার বুদ্‌বুদ্‌ জালের অন্ত নেই। সেই জাল ছিন্ন করিয়া, তাহার তলদেশের শান্ত-স্বচ্ছ-নীল শোভা যিনি দেখিতে ও দেখাইতে পারেন, তিনিই জীবনের শ্রেষ্ঠ রূপকার।

          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর ‘চোখের বালি’ (১৯০৩) উপন্যাসে যেমন কামনা তাড়িত মহেন্দ্রের মনোবিকলনকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে ঘটনা পরম্পরায় ফুটিয়ে তুলে, আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন; তেমনি এই সময়কার কথাশিল্পী হিসাবে স্বয়ং অনিল ঘড়াইও তাঁর ‘মুকুলের গন্ধ’ উপন্যাসে এই জগেন জমাদার চরিত্রের কুরুচিকর দিকটিও তুলে ধরেছেন। একজন বেহেড মাতাল এবং বদমেজাজি যা, ঐ খিচড়ে শুয়োরের স্বভাবী বৈশিষ্ট্যেরই তুল্য। স্ত্রী আন্নাকালীকে কথার বানেই শুধু জর্জরিত করে তুলে সে ক্ষান্ত নয়। বারবার অকপটে স্ত্রী আন্নাকালীর কাছে নিজের কামনালিপ্ত মনের খবর সে স্বীকার করে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। কত সহজেই সে স্ত্রী আন্নাকালীকে পরম বন্ধু সুলভে নির্লজ্জের মতো দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছে –

মনটানলে আমার কি করার আছে বল, আমি তো মনের দাস ছাড়া কিছু নই। ভবে এসেছি সুখ করতে সুখ না করে চলে যাব তা কেমন করে হয়। আমার বাপ ছিল এক কথার মানুষ। রাজার বাগানে ফুল দেখে তার যদি পছন্দ হোত তাহলে যে কারণেই হোক দখল নিত সেই ফুলের। বাপ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেনি গলাতক জল খেয়েই মরেছে। তার ছেলে হয়ে তেষ্টায় বুক ফাটাব- এটাও তো ভাল দেখায় না।

ঔপন্যাসিক এভাবে জগেন চরিত্রের মনের গহন-গোপন রহস্যের জট অনায়াস-সহজলব্ধ ভাবে খুলে খুলে দেখিয়ে, তার খিচড়ে স্বভাবী চারিত্রিক লক্ষণের সঙ্গে মূল কারণ উৎসও অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে শূকর পালকবৃত্তিধারী ঐ জীবনের অনুষঙ্গে এনে দাঁড় করিয়েছেন। ফলে, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে উপন্যাসের কাহিনি আরও আকর্ষণীয়-বাস্তবোচিত রূপে ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। শুধু এই জগেন জমাদারের চারিত্রিক অতলান্ত গভীরে দৃষ্টিপাতই নয়; ঐ সমস্যা দীর্ণ মানসিক জটিলতার মধ্য দিয়ে কাহিনীর দ্রুত উত্থান-পতনও ঘটেছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসাবে জগেন জমাদারের মনোবিকলনের দিকগুলি একে একে যেভাবে পাঠকের সামনে সহজে খুলে বেরিয়ে এসেছে, তাতে এই চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহজেই ধরা পড়েছে। তার অন্তর্জগতের চেতনার চলমান স্রোত; কামনা-বাসনা লিপ্ত মনের চিন্তা ও চেতনার ফেনায়িত তরঙ্গ নির্লজ্জের মতো বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। মনের ইচ্ছাকে সে সংযমের শেকলে বাঁধতে শেখেনি। বরং মনের অবদমিত ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিয়েই সে চার পাশের জীবনকে তছ্‌নছ্‌ করে দিয়েছে। নিজেও যেমন স্থির থাকতে পারেনি, তেমনি তার চারপাশের মানুষজন তথা, স্ত্রী আন্নাকালী, পুত্র অর্জুন সহ চারপাশের মানুষজনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের সুরেশ যেমন মনের তীব্র ইচ্ছায় লালিত। যে ইচ্ছাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেনি। কিম্বা, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মহেন্দ্র। যার জীবনে স্ত্রী আশালতা থাকা সত্ত্বেও অতি দীন, ভিক্ষুকের মতো বিধবা বিনোদিনীর পশ্চাতে রাত-দিন ছুটে বেড়িয়েছেইচ্ছা করেই নিজের দুর্দমনীয় ইচ্ছাকে সে লালন করেছে। মনের ইচ্ছাকে সে কখনোই সংযত করতে শেখেনি। বরং মনের ভোগাকাঙ্ক্ষাকে সে নির্লজ্জের মতো প্রশ্রয় দিয়ে চারপাশের জীবনকে জটিল ঘূর্ণাবর্তে টেনে নিয়ে গিয়েছে। আলোচ্য অনিল ঘড়াইয়ের ‘মুকুলের গন্ধ’ উপন্যাসের জগেন জমাদারও অনুরূপভাবে মনের ইচ্ছাকে দমন না করে বরং বিধবা যশোদাকে পাওয়ার লোভে সেই কামনার শিখায় জ্বলে-পুড়ে অহরহ ছটফট করছে ডানাভাঙা পাখির মতো। স্ত্রী আন্নাকালীকে সেই মোহের আগুনে ঝলসে মারতে দ্বিধাবোধও করেনি। বরং সরাসরি স্ত্রীকে আঘাত হেনে নির্লজ্জের মতো দাঁত-নখ বের করে বলেছে –

আমার সংসারে তুই হলি ঐ পেঁপে গাছের মতন তোকে আমি রাখতে পারি, আবার মারতেও পারি। আমার যা ইচ্ছে তা করতে পারি।...

এভাবে জগেন জমাদার তার মনের সমস্ত কামনা-বাসনাকে বার-বার প্রশ্রয় দিয়েছে। তার মূঢ়তা, খিচড়ে শুয়োরের স্বভাব-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই চার পাশের জীবনকে বার-বার অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিগত যৌবনা আন্নাকালীর থেকে শুধু মুখ ফিরিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত নয়; বরং এভাবে তাকে কথার শেল বিঁধে জর্জরিত করে তুলতে গিয়ে বলেছে –

আমার নাম জগেন জমাদার, অন্যের ময়লা ঘেঁটে-ঘেঁটে আমার মনটাও ময়লা হয়ে গিয়েছে। দয়া-মায়া সব শুকিয়ে গিয়ে আমি এখন গাছের একটা মরা ডাল। কেউ যদি আমার মরাগাছে ফুল ফোটাতে চায় তা হলে তুই বাধা দিবিনে। কেউ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে তার পরিণাম ভালো হয় না।

তারই পরিণাম হিসেবে উপন্যাসের একেবারে বাইশ তম অধ্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, বচসার সূত্র ধরে জগেন শাবল দিয়ে স্ত্রী আন্নাকালীকে একেবারে মাথার সিঁথি লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করে। তাতেই তার নিষ্ঠুর ভাবে মৃত্যু ঘটে। অনেকটা ঠিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের পালক পিতা গফুর মিঞার হাতে যেমন করে তার পুত্র সম মহেশের লাঙলের ফলার আঘাতে নির্মম ভাবে মৃত্যু ঘটেছিল। এখানে, পরনারীতে আসক্ত, নিষ্ঠুর স্বামী জগেন জমাদারের হাতে আন্নাকালীর মৃত্যু পরিণাম আরো ভয়ঙ্কর-শোচনীয়, মর্মান্তিকও বটে। মদ্যাসক্ত কামনার লেলিহান শিখায় ঝল্‌সে ওঠা জগেন জমাদার পুত্র অর্জুনকেও অকালে মাতৃহারা করেছে। জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়নার কাছে নিজের ক্রোধকেও সে সংযমের বশে রাখতে পারেনি। তাই, খিচড়ে শুয়োরের স্বভাবী মনটাকে নিয়ে এক সময় সে পশুত্বের চরম সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার সমস্ত ইচ্ছার বেগ ছিল একেবারে উচ্ছৃঙ্খল।

          ‘চোখের বালি’র মহেন্দ্র যেমন, রবীন্দ্রনাথের কথায় –

বাল্যকাল হইতে (মহেন্দ্র) দেবতা-মানবের কাছে সর্বপ্রকারে প্রশ্রয় পাইয়াছে, এই জন্য তাহার বেগ উচ্ছৃঙ্খল।

তেমনি এই জগেন জমাদার, যে কিনা সংসারের শত অভাব-অনটন সত্ত্বেও বিধবা যশোদাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় বেহেড মাতাল হয়ে বাড়ী ফিরেই স্ত্রী আন্নাকালীর সঙ্গে নানা খিস্তি খেঁউড়ের সঙ্গে বাক্‌যুগ্ধে নামে। সেই বচসা থেকে ক্রমে হাতাহাতি। এমন বেপরোয়া তার স্বভাব। কামনার পিপাসায় সে বেহেড মাতাল থেকে পশু হয়ে ওঠে। তাই পেটের খিদা তার অজুহাত মাত্র। যে অজুহাতে সে হুঁকার দিয়ে বলে – “ভোখ লাগলে ঠাকুর-দেবতা আমার কাছে কিছু নয়।”১৪ ক্ষুধা শুধু জঠরের নয়। শিশ্মের ক্ষুধাই তাকে বিপথে তাড়িত করেছে। সমাজের একেবারে প্রান্তিক অন্ত্যজ-অচ্ছুত শ্রেণির মানুষ এই জগেন জমাদার চরিত্রের মনোবিশ্লেষণের দিকটি ঔপন্যাসিক অনিল ঘড়াই এভাবে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাতার ভূমিকা নিয়ে ঐ জীবনের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-যৌনলালসার মতো বিরংসাময় চিত্রগুলি কঠিন বাস্তবের মাটিতে এনে ফুটিয়ে তুলেছেন।

          কিন্তু উপন্যাসের অন্তিম পরিণতিতে দেখা যায়, যে বিধবা যশোদাকে পাওয়ার কামনায় জগেন একসময় অন্ধ হয়ে উঠেছিল; সেই যশোদা ঘটনাচক্রে শহুরে কিছু শিক্ষিতদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে চরম অপমান আর অসহায়তার বিপন্নতায় ডুবে গেলে জগেন তার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। এমন ঘটনায় জগেন জমাদারের ভেতর থেকে একজন সৎ-বিবেকী মানুষ বেরিয়ে আসে। লেখক তার এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একজন গুণী-প্রেমিক মানুষের পরিচয় তুলে ধরেছেন। জগেন জমাদারের পুত্র হয়ে অর্জুনও তার জীবনে টিয়া, নয়তারা আর বাসমতী নামের তিন-তিনটি নারী এলেও, কোনো নারীর ঘাটে তার জীবন তরীকে বাঁধেনি। বরং পিতার খিচড়া স্বভাবী কামনা লিপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করে সে উত্তরণের পথ খুঁজে ফিরেছে। এভাবে ঔপন্যাসিক জৈবিক প্রবৃত্তি তাড়িত নিম্নবৃত্তিয় সমাজের একেবারে পিছিয়ে পড়া নর-নারীর নানা সংঘাত আর দ্বন্দ্ব নিয়ে এই ব্যতিক্রমী ‘মুকুলের গন্ধ’ উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণে আঁতের কথার মধ্য দিয়ে জীবন স্পর্শী তথা, জীবনগন্ধী উপন্যাস রচনা করেছেন। যে উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় ধরা আছে গ্রাম-বাংলার মায়াবী প্রকৃতি ও সেই সজীব প্রকৃতির  কোলে চলমান প্রান্তিক মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস।

          উপন্যাসের এই জগেন চরিত্র পরিকল্পনা প্রসঙ্গে লেখকের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম – 

এই চরিত্র তাঁর অতি চেনা। যার জীবন প্রবাহের নিত্যসাক্ষী এমনকি, দোসরও তিনি। যারা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে শুকর পালন করে। তারা ভক্তি ভরে ‘বরাহ’ দেবতার পূজা করে। এখনও তাদের কেউ-কেউ ঐ পেশায় যুক্ত। অনেকে আবার অন্য পেশায় চলে গেছে।

ঐ সকল জীবন প্রবাহের সুখ-দুঃখময় যাপন পদ্ধতির নিত্য সাক্ষী হিসেবেই এমন কাদা-মাটি সংসারের শ্যাওলার গন্ধ জড়ানো নর-নারীর মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জীবনের আসল ঐশ্বর্যকে ছুঁতে চেয়েছেন। সে কারণেই কথাশিল্পী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করতে পেরেছেন –

কাদামাটি সংসারের শ্যাওলা সরিয়ে

যে কাটে সাঁতার,

সেই খোঁজে জীবনের আসল ঐশ্বর্য।

 

 

                    -ড. চঞ্চল কুমার মণ্ডল, বাংলা বিভাগ, সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়